বিদায়
সেইদিনের কথা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আম্মা বাড়ির পেছনে হাঁস মুরগির খামার থেকে একটি রাজ হাঁস নিয়ে এলেন। বড় ভাইয়ের আবদার হাঁসের মাংস খাবে। ঝাল করে রান্না করা হাঁস,সঙ্গে আছে গরম ভাত,ডাল আর শীতকালীন সবজি। সব কিছু মেঝেতে সাজিয়ে,মা ভাইয়াকে ডাকলেন,খোকা খেতে আয়। ভাইয়া হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেছিলেন ঠিকই,কিন্তু মায়ের হাতের সেই হাঁস আর খাওয়া হলো না।
বাড়ির দরজায় কড়া নোড়ছে,তারা এইখানে পৌঁছে গেছেন। আম্মা ভাইয়ার হাতটা তখনও ধরে আছেন। ভাইয়া বললেন আমাকে নিয়ে ভেতরের ঘরে যেতে। বাবাও বাধা দিতে চাইলেন কিন্তু ভাইয়া সাহসের সাথে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। দরজার ওপারে কয়েকজন সেনাসদস্য ,হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখান দিয়ে আবার উর্দুতে কি যেন বলছে।যে মুহূর্তে আমার ভাই দরজা খুলতে গেল, সেই মুহূর্তে তাকে বন্দী করা হলো। আমাদের চোখের সামনে তারা আমার ভাইকে ধরে নিয়ে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না।
আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় তিনি, সে বছর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার বড় ভাই ছোট বেলা থেকেই বেশ সাহসী। বলতে গেলে একজন সহজ-সরল ব্যক্তি, যিনি কথা গোপন রাখতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তিনি আমাকে তার সমস্ত গোপন কথা গুলো বলতেন। বিশেষ করে তার কলেজে পড়ুয়া একটি মেয়ের ব্যাপারে যার সাথে ভাইয়ার প্রেম ছিল। তিনি আমাকে কখনই বলেনি যে সে কীভাবে তার সাথে দেখা করেছে। তার বাবা চাঁদপুরের রেডিও স্টেশনের প্রধান রেডিও অ্যাটেনডেন্ট। তারা উভয়েই একই কলেজে ভর্তি হয়েছিল, যেখানে তারা একে অপরের সাথে দেখা করেছিল। ভাইয়া সবসময়ই একজন ফ্যাশন প্রেমি মানুষ ছিলেন এবং কলেজে বা এলাকায় তার ড্রেসিং স্টাইলের জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিলেন।
একবার এক মিছিলে, খুব কাছ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা দেখার পর আমার ভাইয়ের মনের অজান্তেই একটি পরিবর্তন শুরু হয়। কলেজে থাকা অবস্থায় আমার ভাই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দেওয়া শুরু করেন। এই কারণে এলাকার শীর্ষ পাকিস্তান পন্থি নেতারা আমার বাবাকে প্রায়শই ধমকি-ধামকি দিতেন যার ভয়ে আমার বাবা, না চাইতেও একটি পাকিস্তানি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন, যাতে করে তারা আমার ভাইয়ের কোন ক্ষতি না করে। কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হল না।
আমার মনে আছে একবার, আমাদের বাড়ির কাছের একটি খালে একটি লাশ ভেসে এসেছিল, বা হয়ত কেউ ফেলে দিয়েছিল। লাশটিতে বেশ কয়েকটি গুলির চিহ্ন, আর এই নৃশংস অত্যাচার সামনা-সামনি দেখার জন্য গ্রামের আনাচেকানাচে থেকে লোকজন সেই খালের পাশে ভিড় করেছিলেন।আমার মা এইগুলো দেখলে ভয় পান,তাই আমার ভাই আমার মা না চাইতেও তাকে, সেই লাশ দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে লাশটি দেখিয়ে তিনি আমার মাকে বলেছিলেন "এই মা দেখুন, বুলেট এর বের হওয়ার ক্ষত সবসময় বড় হয়, যদি আমি যুদ্ধে মারা যাই, এবং আমার গায়ে গুলি লাগে তাহলে আমার দেহ এই রকম কোনো এক নালায় ফেলে দেওয়া হবে। তবে তুমি ভয় পেয়ো না কিন্তু দেখতে যেমন লাগুক না কেন দেহটি আমারই হবে "।
আমার ভাই ছোট বেলা থেকেই বিষণ সাহসী ছিলেন। সময়টা ছিল আগস্টের শেষের দিকে যখন, আমার ভাই সিদ্ধান্ত নেয় যে সে ভারতে গিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও চালানোর প্রশিক্ষণ নেবে। সে ভালো করেই জানতো মা-বাবা তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিবে না তাই সে কাউকে না বলেই রাতে চলে গেল। যাওয়ার আগে আমার বালিশের কাছে একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিল জেতাতে লেখা ছিল “আমার প্রিয় বোন আমি আমার মা-বাবাকে এবং তোমাকে সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি।কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি নয়।আমাকে যেতে হবে এটা আমার দেশের জন্য এবং এটা আমাদের স্বাধীনতার জন্য"। চলে যাওয়ার ঠিক আগে সে তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে তার শেষ চিঠি লিখেছিল। আমাদের বাড়িতে তখনও জেউ অবন্তির ব্যাপারে জানতো না। ভাই পালিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরে, মেয়েটি আমাদের বাসায় আমার ভাইকে খুঁজতে এসেছিল, তখন আমরা তার পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারি।ভাইয়া তার বান্ধবীকে লেখা চিঠিতে লিখেছিল "আমার প্রিয়তমা, আমাদের দেখা হওয়ার দিনটি আমার এখনও মনে আছে। তোমার হাসি সবসময় আমাকে দিয়েছে শক্তি এবং সান্ত্বনা, তাই আমি তোমার কাছ থেকে হাসি নিয়েই বিদায় জানানোর অনুরোধ করছি। আমি জানি, আমি তোমাকে বিয়ে করবো বলে কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা হয়তোবা পূরণ হবে না। আমিও স্বপ্ন দেখতাম, আমাদের একটা সুখের সংসার হবে কিন্তু এখন তা সম্ভব না। আমি তোমাকে আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি এবং ভালোবেসে যাবো, কিন্তু আমার দেশের প্রতি আমার ভালবাসা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমাকে যেতে হবে, আমার দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে এবং এখন আমি তার প্রতিদান দিতে চাই। আমি যদি তোমার কাছে ফিরে আসতে ব্যর্থ হই তাহলে ভেবে নিও আমি দেশের জন্য আমার জীবন দিয়েছি।তখন অন্য কাউকে বিয়ে করে নিও। শুভ বিদায় প্রিয়তমা"।
মেয়েটির বাবা ছিলেন একজন রেডিও কর্মকর্তা তিনি আমার ভাইয়ের সাথে তার মেয়ের প্রেমের কথা জানতে পেরে বিষণ রেগে গিয়েছিলেন যার ফলে তিনি তার মেয়েকে বেশ কয়েক সপ্তাহ বন্দী করে রেখেছিলেন।এর পরে আর ওদের সাথে আমাদের কথা হয়নি।
আমাদের প্রতিবেশী জসিম কাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন তথ্যদাতা ছিলেন, তিনি কীভাবে যেন জানতে পারেন যে আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এবং তখন থেকেই তিনি নিয়মিত আমাদের বাড়িতে টহল দিতেন এবং ভাইয়ার সম্পর্কে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। একদিন আমরা আমার ভাইয়ের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম। সে তখন যশোরে একটি মুক্তি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তার চিঠিতে সে লিখেছে "মা এখনো রাগ করে আছেন, যুদ্ধে আমি আহত হয়েছি, বুলেটের আঘাতে আমার পায়ে মারাত্মক জক্ষম পেয়েছি, আমার প্রশিক্ষক বলেছেন আমি আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারব না। আপনি ও বাবা এটি শুনে খুশি হবেন এটা জেনে, যে আমি সুস্থ হওয়ার জন্য বাড়ি ফিরছি"।
এটা আমার মায়ের কাছে ঈদের মতো ছিল, তিনি আমার ভাইয়ের প্রিয় খাবার হাঁসের তরকারি রান্না করে ছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভাইয়াকে হানাদার বাহিনীরা ধরে নিয়ে যায়। হয়ত পারার কেউ বা জসিম কাকা আমার ভাইকে গভীর রাতে, আমাদের বাড়ির ভিতরে আসতে দেখেছিল। আমার ভাই পালিয়ে যেতে পারত, কিন্তু পাকিস্তানিরা মহিলাদের সাথে,বিশেষ করে মেয়েদের সাথে নৃশংস অত্যাচার করতো। তাই ভাইয়া আমাকে এবং আমার মাকে বাঁচানোর জন্য সাহসের সাথে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন।
আমাদের জানানো হয়েছিল যে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য খুঁজতে আসতে পারে। তাই আমাদের নিরাপত্তার ভয়ে আমার বাবা, আমার ভাইয়ের প্রশিক্ষণ এবং অংশগ্রহণের সমস্ত কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। আমার বাবা বেশ কয়েকবার স্থানীয় সামরিক বাহিনীর কাছে গিয়েছিলেন, এই উদ্দেশ্যে যেন তারা টাকার বিনিময়ে আমার ভাইকে ছেড়ে দেয়, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আমার ভাইয়ের গ্রেপ্তারের কয়েকদিন পর আমরা জসিম কাকাকে আমার ভাইয়ের শাল পরতে দেখি, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে এটি আমার ভাইয়ের ছিল কারণ এটি একটি বিশেষ শাল যা আমার ভাই রাজশাহী থেকে এনেছিলেন এটি খুব সুন্দর নকশা করা ছিল। জসিম কাকাকে দেখার পর এটি নিশ্চিত হয়ে গেল যে তিনিই সেই রাজাকার যিনি এখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাঠিয়েছিলেন।
একজন সহবন্দীর কাছ থেকে আমরা আমার ভাইয়ের সম্পর্কে জানতে পারি, তার মতে তাকে একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সাথে একটি টর্চার সেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তথ্য আদায়ের জন্য তাদের নির্যাতন করতো। কিন্তু হে আল্লাহ তারা সাহসী ছিলেন , যে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রুমে রাখা হয়েছিল তাদের কেউই কিছু বলেনি। সে কারণেই তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়। এক মধ্যরাতে আমার ভাই কোনোভাবে নর্দমার মধ্য দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়, কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার ভাই পালানোর সময়, সেই গ্রামের একটি মেয়ে আমার ভাইকে দেখে ফেলে। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন পালানোর কথা জানতে পারে তখন তারা একটি অনুসন্ধান দল পাঠানয়। অনুসন্ধান দলটি মেয়েটিকে খুঁজে বের করে এবং যখন তারা তাকে জিজ্ঞাসা করে, সে কিছু দেখেছিল কিনা সে বলে দেয় যে আমার ভাই কোনদিকে পালিয়েছিল৷ আমার ভাইকে শীঘ্রই ধরে আনা হয় এবং অন্য একটি শেলে আটকে রাখা হয়। যুদ্ধের সময় ভাইয়ার কাছের এক বন্ধুর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি যে,ভাইয়াকে ফের আটক করার পরেই তাকে হত্যা করা হয় এবং একটি গণকবরে ফেলে দেওয়া হয়। আমরা সেখানে গিয়েছিলাম, কিন্তু ততদিনে সব কিছু মলিন হয়ে গিয়েছিল, সামান্য চিহ্নও ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের এলাকার বাসিন্দারা সেখানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপন করে, যা আজও আছে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এবং আমাদের স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমার ভাইয়ের সহকর্মীরা জসিম কাকার উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছিল। কিন্তু আমার বাবা তাদের বারণ করে দেন। তিনি বলেছিলেন যে জসিম কাকাকে হত্যা করলেও তার ছেলে আর ফিরে আসবে না। তাই জসিম কাকাকে ছেড়ে দেওয়া হল।
মাঝে মাঝে ভাবি এরা কেমন পুরুষ? ঠিক আমার ভাইয়ের মতো তাদের অনেকের নাম লোকেরা ভুলে যাবে কারণ তাদের জন্য কোন কাগজপত্র নেই। তবে তারা আমাদের হৃদয়ে চিরকাল থাকবে। এমন সাহসী হৃদয়কে স্যালুট।
Md Rizwan Ullah Shuvo
ID: 20303016
Fall 2020, Student of BBA department
Canadian University of Bangladesh
Total Views: 1306